ইমাম খাইর, সিবিএন:
ঠাণ্ডাজনিত ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়া প্রতিরোধে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শিশুকে রোটা ভাইরাস টিকা দিবে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। এ জন্য মন্ত্রণালয়কে চাহিদাপত্র জানিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। খবর নিশ্চিত করেছেন সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ আবদুস সালাম। তিনি বলেন, আমরা মন্ত্রণালয়কে লিখেছি। রকোজিশন দিয়েছি। ডব্লিউএফসি, ইউনিসেফ সহযোগিতা করলে দ্রুত হয়ে যাবে। প্রসেসে আছে। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সিভিল সার্জন বলেন, আমরা ইতোমধ্যে হাম-রুবেলার টিকা দিলাম। ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ালাম। কলেরা ভ্যাকসিন খাওয়ালাম। একটার পর একটা প্রসেস হচ্ছে, আর কি।
একদিকে শীত মৌসুম অন্যদিকে পানির স্তর ক্রমশ নামতে থাকায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগের আতংক। এরই মাঝে বেশ কিছু রোহিঙ্গা শিশু-নবজাতক ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প ও ক্লিনিকে তাদের চিকিৎসাসেবা চলছে। এ অবস্থায় রোটা ভাইরাস টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
ইতোমধ্যে ডায়রিয়া ও কলেরা রোধে গত দেড় মাসে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে কলেরা ভ্যাকসিন খাওয়ানো হয়েছে।
এদিকে শীত এখনো জেঁকে না আসলেও উখিয়া এবং টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে দেখা দিয়েছে শীতবাহিত রোগের প্রকোপ।
বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে ঠাণ্ডাজনিত ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বেশি।
অক্টোবরের মাঝামাঝি দেশে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করে। কিন্তু সমুদ্র অঞ্চল কক্সবাজারে শীত একটু দেরিতে আসে। তবে নভেম্বরের শুরু থেকে এখানে ব্যাপক কুয়াশা পড়ছে। শীতের এই ঠাণ্ডা আবহাওয়া এবং কুয়াশার কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের।
মিয়ানমার থেকে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে দু’লাখের বেশি রয়েছে শিশু। আর চলতি শীত মৌসুমে এসব শিশুরাই সবচে বেশি ভোগান্তিতে পড়বে বলে আশংকা চিকিৎসকদের। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যাপ্ত শীত বস্ত্র সরবরাহে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানালেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
রোটা ভাইরাস:
আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ধরণের রোগের জীবাণু বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সুযোগ পেলেই এরা আমাদের সংক্রমিত করে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। রোটা ভাইরাস তেমনই এক দুষ্ট জীবাণু যা দেখতে চাকার মত। এই ভাইরাস মারাত্মক এক ডায়রিয়া সৃষ্টি করে যা রোটাভাইরাল ডায়রিয়া নামে পরিচিত। আর এই রোটাভাইরাল ডায়রিয়া সব শিশুদের বিশেষ করে নবজাতকের জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।
রোটা ভাইরাসের ভয়াবহতা:
রোটাভাইরাল ডায়রিয়ার কারণে সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৬ লাখের ও বেশী শিশু মৃত্য বরণ করে। বাংলাদেশের প্রতি বছর প্রায় ২৪ লক্ষ শিশু রোটা ভাইরাস জনিত পরিপাকতন্ত্রের প্রদাহে ভোগ। প্রতিবছর ৩ লাখেরও বেশী শিশু মারাত্মক সংক্রমণে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রায় অনেক শিশু মৃত্যু বরণ করে।
শীতকালে শিশুদের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী সংক্রামক ভাইরাস ‘রোটা’। তবে শিশুকে এই ভাইরাস থেকে প্রতিরোধ করতে রয়েছে ভ্যাকসিন। দুই বা তিন ডোজের রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন নিয়ে শিশুকে রাখা যায় নিরাপদ।
জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ মোহাম্মদ শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা রোটা ভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত হয় বেশি। আর দুই বছরের কম বয়সী শিশুরা আরও বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
রোটা ভাইরাস হচ্ছে নবজাতক ও শিশুদের ডায়রিয়াজনিত রোগ ও পানিশূন্যতা প্রধান কারণ। আক্রান্ত হওয়ার ২-৩ দিন পর সাধারণত এ রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুর মারাত্মক ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, জ্বর ও পেট ব্যাথা হয়। রোটা ভাইরাসের সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা না থাকলেও পানিশূন্যতা রোধে বারবার পানি খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়।
রোটা ভাইরাস নিয়ে সর্বশেষ গবেষণায় আরো দেখা যায়, ডায়রিয়াজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এবং ৬ থেকে ১১ মাস বসয়সী শিশুর প্রায় ৫০ শতাংশ রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত।
ডায়রিয়াজনিত অন্যান্য রোগের চেয়ে রোটা ভাইরাসের চিকিৎসা সম্পূর্ণ আলাদা। আবার রোটা ভাইরাস টিকার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে। ভাইরাসগুলোর প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। এটি অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় অনেকটা আলাদা ধাচের। এ রোগ প্রতিরোধে এখন দুটি নতুন রোটা ভাইরাস টিকা আছে। আমরা আশা করছি এ টিকা ইপিআই (টিকাদান সম্প্রসারণ কর্মসূচি)’তে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিয়োলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর)’র তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডায়রিয়াজনিত অন্যান্য রোগ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলেও বাংলাদেশে রোটা ভাইরাসের হুমকি এখনো অনেক বেশি।
২০১২ সাল থেকে সরকারি কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী সাতটি বিশেষায়িত হাসপাতালে মূলত এ রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা দেয়া হয়। এসব হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৫১ শিশুর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ১২৪ শিশু (৮২ শতাংশ) রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। এদের অধিকাংশের বয়স ৬ থেকে ১৭ মাস।

চিকিৎসা
পানিশূন্যতা পূরন করার জন্য ঘন ঘন খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। শিশুর পানিশূন্যতা বেশি হলে এবং মুখে স্যালাইন না খেতে পারলে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে ভর্তি করে শিরাপথে স্যালাইন দিয়ে পানিশূন্যতা পূরণ করতে হবে।
প্রতিষেধক
রোটা ভাইরাল ডায়রিয়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দুইভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
প্রথমত, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন, শিশু যে সমস্ত জিনিসপত্র ব্যবহার করে সেগুলো সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। শিশু যে সমস্ত খেলনা নিয়ে খেলা করে তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং আপনার হাত, এমনকি খাবার তৈরি করার স্থান সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। সর্বোপরি শিশুদের ৬ মাস পর্যন্ত শধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো।
দ্বিতীয়ত, শিশুকে রোটাভাইরাসের টিকা খাওয়ানো। বর্তমানে প্রতিষেধক হিসাবে রোটা ভাইরাস এর টিকা বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
কেন এই টিকা জরুরী?
গবেষণায় দেখা গেছে উন্নত জীবনযাত্রা মেনেও অনেক ক্ষেত্রে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায় না। সর্বোপরি ২ মাস থেকে ৬ মান বয়স্ক শিশুদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী থাকে। তাই এই বয়সের শিশুদের রোটাভাইরাল ডায়রিয়া মুখে খাবার স্যালাইন দিয়ে সারিয়ে তোলা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই শিরাপথে স্যালাইন দিয়ে পানিশূণ্যতা পূরণ করতে হয়। তাই এই টিকার বিকল্প নেই।
টিকা কখন দিতে হবে?
রোটা ভাইরাসের টিকা দিতে হবে দেড় মাস থেকে ছয় মাসের মধ্যে। এই টিকা মুখে খাওয়ানো হয়। প্রথম ডোজ দেয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ কমপক্ষে ১ মাস পর ‍দিতে হয়। এই টিকা দিলে রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া হবে না। শিশু রোটাভাইরাস জনিত ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যু থেকে রক্ষা পাবে। সুতরাং শিশুদের জীবন রক্ষার্থে তাদের পরিচর্যার পাশাপাশি রোটা ভাইরাস ডায়রিয়া থেকে পরিত্রান পেতে সময়মত টিকা দিয়ে শিশুদের ডায়রিয়া থেকে রক্ষা করুণ।